পাঠ্যপুস্তক
আমার ছোটোবেলা কেটেছে মফস্বল এলাকায়। বাবার ছিল সরকারি চাকরি। মা বলতে গেলে প্রায় একাই আমাদের দেখাশোনা করতেন। পড়াশোনার ব্যাপারটাও তার অধীনে ছিল। মায়ের খুব পড়ার শখ। মায়ের মতোই দিদিরা ছিল খুব পড়ুয়া ।
.
.
মফস্বল শহর। মাঝে মাঝেই লোডশেডিং হতো। চার্জার লাইট দিয়ে দিদি তখনো উচ্চঃস্বরে পড়ে যেত
“Bangladesh is a small country with a large people..It is a beautiful country… “
কিছুই বুঝতাম না। অক্ষরজ্ঞান হয়নি তখনো। তবে এটুকু বুঝতাম লেখাটা বাংলাদেশ নিয়ে লেখা। ইংরেজি পড়া। শুনতে ভারী ভালো লাগতো।
.
ইশ্ কবে যে আমি অমন হড়বড় করে ইংরেজি পড়তে পারব!
.
শেষে একদিন বাবা অফিস থেকে এলেন। সাথে বর্ণমালার বই। সন্ধ্যায় মা নিজেই বসে গেলেন বই হাতে
“অ তে অজগর
আ তে আলো…”
শুরু হলো বইয়ের সাথে পথচলা।এখনো চলছে।
.
মজার ব্যাপার সে বয়সেই আমি ছিলাম খুব পড়ুয়া। বর্ণমালার চেয়ে দিদির মোটা মোটা বইগুলো আমাকে বেশি টানতো।
খেলার ছলে মাঝে মাঝে বই গুলো হাতে নিতাম। কোনোদিন দিদির চোখে পরলে খেঁকিয়ে উঠত
“ওটা কেন ধরেছিস??ছাড়্ ছাড়্।”
.
বইটা কোনোমতে টেবিলের উপর রেখে দিতাম ভোঁ দৌড় । দিদি খুব মজা পেত। মাকে ডেকে বলতো
“মা,ও মা, তোমার মেয়ে তো সেয়ানা হয়ে গেছে গো। বঙকিমের বই নিয়েছে হাতে। হা হা হা।”
মা ও তখন আরেকচোট হাসতেন।
.
.
ধীরে ধীরে অক্ষরজ্ঞান হলো। কত কি যে পড়তাম। গল্প, কবিতা। না না।ঠিক কবিতা না। ছড়া।
.
“হাট্টিমা টিমটিম
তারা মাঠে পাড়ে ডিম।
তাদের খাড়া দুটো শিং
তারা হাট্টিমা টিমটিম।”
.
ভারী মজা লাগতো। ওমা! এও কি পড়া! কত্ত সোজা!
.
ছোট ছোট গল্প,কবিতা,ছড়া,ইংরেজি রাইমস সব ই ভালো লাগতো। কিছু কিছু মজার ভুল ও হতো। বহুদিন আমি ছোট হাতের বি আর ডি লিখতে গিয়ে দ্বিধায় পড়তাম। বল লিখতে গিয়ে কতোবার যে ডল লিখেছি তার ইয়ত্তা নেই। স্যারেরা তখন হেসেই কূল পেতেন না।
.
প্রাথমিকের সব ই ভালো লাগতো। সরকারি স্কুল। পড়াশোনার বালাই নেই। কিন্ডারগার্টেনের বন্ধুদের দেখতাম খুব চাপ। গাদা গাদা নোটস আর গাইড দিত ওদের। খুব হাসি পেতো আমার। ওকি! এতো পড়া! করো করো মুখস্থ করো। গরমিল হলেই নম্বর কাটা। সে কি অত্যাচার। মুখস্থ হতে হবে। ডাহা মুখস্থ। সেটাই না হলে আর কিসের পড়া!
.
.
মাধ্যমিকে গিয়ে দেখি অন্য ব্যাপার। আমাদের সময় চালু হয় সৃজনশীল। এর মানে বোঝানো হলো এবার থেকে আর মুখস্থ নয়। নিজে বুঝে নিজের তৈরী লেখা লিখতে হবে। সে বড়ই দুঃসময়। শিক্ষকেরা নিজেই হিমশিম খেতে লাগলেন। ছাত্ররা অকূল পাথারে। শেষ ভরসা শিক্ষকদের নিজেদের মেধা আর গাইডলাইন। তারা সেটাই করলেন।
.
.
যথারীতি রেজাল্টে দেখা দিল ভরাডুবি। স্কুলে কাজ চলছে না। ছাত্ররা তাই দলে দলে প্রাইভেট আর কোচিং এ ভিড়তে লাগল।
.
.
সেই বইগুলোর পাতায় পাতায় যেন ধাঁধাঁ। সব বিষয়ই কেমন যেন ঘোলাটে। স্বচ্ছ নয়। স্কুলের বাইরের চাহিদা বাড়তে লাগল হিড়হিড় করে। পকেট ভারী হতে লাগলো কারো কারো।
.
.
মাধ্যমিকের পর উচ্চমাধ্যমিকেও একই ব্যাপার। বাংলা,ইংরেজির মতো সহজ আর সাহিত্যের রসময় বিষয়গুলো ছাত্রদের কাছে হয়ে গেলো কাঠখোট্টা বাড়তি বোঝা।
.
.
আমার খুব সৌভাগ্য যে আমি খুব লিবারেল পরিবারে জন্মেছি। বাইরের বই নিয়ে বাড়িতে তাই কখনোই নাক কুচকানো ব্যাপার ছিলনা। পড়াশোনার চাপ ছিলনা। পাঠ্যপুস্তক তাই কখনোই পাঠ্যপুস্তক মনে হয়নি।
বইয়ের টপিকগুলো খুব সহজেই বুঝে উঠতাম।
.
.
কিভাবে? খুব জটিল কিছু নয়। সোজা বাংলায় যাকে বলে স্টাডি করতাম। টপিক ধরে ধরে পড়তাম। সেটা নিয়ে চিন্তা করতাম। ডিসকাস করতাম বন্ধুদের সাথে। বাইরের বইয়েও খু্ঁজতাম বিষয়গুলো। তাতেই হয়ে যেতো।
.
.
এটা সত্যি বইগুলো বড় জটিল হয়ে গেছে আজকাল। বড় বড় বিষয় খুব ছোট করে ধরে রাখা হচ্ছে। তাতে বই ছোট হলেও ছাত্রদের জানার পরিধি বাড়ছে না।
.
.
বইগুলো যদি আরো বেশি আকর্ষনীয় করে তোলা যেতো,সহজ সরল ভাষায় জটিল বিষয়গুলো তুলে ধরা হতো,নৈতিকতার চর্চা হতো, যদি শুধু ভালো ফল ই নয় ভালো মানুষ হওয়াটাই মূখ্য হতো তবে পাঠ্যপুস্তক কখনোই পাঠ্যপুস্তক বলে মনে হতোনা। বইয়ের আগে ‘পাঠ্য’ শব্দটা কখনোই ভীতির সঞ্চার করতোনা।
.
.
তবে আমি খুব আশাবাদী। এ বইগুলোই খুব জলদি আমাদের গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। ছাত্রদের দেবে মনের খোরাক।