মতি
গতরাত থেকে আমার মেয়েটা কথা বলছেনা। চুপচাপ। ঠান্ডা। আমি খেয়াল করেও করিনা। বাচ্চা মেয়ে। সবসময় খেলবে আর হাসবে তা তো নয়। আমি রান্না করে যাই। ওকে স্কুলে দিয়ে আসি। ফিরে এসে মতিকে চা নাশতা দেই। মতি চুক চুক করে চা টা গিলে ফেলে। মতি আমার ছোট চাচার ছেলে। চাচার বয়স হয়ে গেছে। চাচী অনেক আগেই গত হয়েছেন। ছোট মতিকে নিয়ে যখন চাচা সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন আমি তখন নতুন নতুন চাকরিটা পেয়েছি। মতিকে কোলে নিয়ে আমি তাই ওর মা হয়ে যাই।
“চাচা, মতিকে আজ থেকে আমার কাছেই রাখবো। ওর মানুষ দরকার। “
চাচা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।
আমি মতিকে নিয়ে আমার ছোট্ট ঘরে ফিরে আসি। ওকে খাওয়াই। পড়াই। ও আমাকে আম্মা ডাকতে শুরু করে। আমি ডাকি বাবাই। আমার বাবাই।
সে অনেক আগের কথা। তারপর জামান আসে। আমি ওর প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকি। আমার বাবাই আর আমি জামানের সাথে ডেট এ যাই। বিয়ের পর শপিং করতে গেলেও আমার হাত ধরে থাকতো বাবাই। জামান হিংসে করে বলতো,
“ওকেই বিয়ে করে নিলে ভালো হতোনা?”
আমরা হাসতাম। সারাদিন খাটুনি শেষে ঘরে ফিরতাম। কোনোদিন ও জামান আমার জন্য বেলি ফুল আনেনি। আমি ওকে ভালোবাসি বলিনি। কিন্তু খুব সুন্দর করেই আমার বাবাই আর আমাকে আগলে রাখতো জামান। হ্যাঁ, রাখতো। তারপর ও চলে গেলো। মরে গেলো। বাসের নিচে পড়ে থাকলো। কেউ এলো না। আমি একা একা সব গুছিয়ে নিলাম। আমার মেয়েটা এলো। আমার জামানের মেয়ে। আমি ওকে আগলে রাখলাম।
মেয়েটা একটু বড় হলো। আজকাল তাই প্রায়ই শুনি। মেয়ে টা একা থাকে। ওকে সময় দেওয়া উচিত। বাপ নাই। বিয়ে কিভাবে দেবো। আমি চুপ থাকি। আগের মতোই। মেয়েকে গল্প শোনাই। মুক্তির গল্প। স্বাধীনতার গল্প। আমার মেয়েটা মন দিয়ে শোনে। যুদ্ধের গল্প। বাংলার মেয়েদের গল্প। তাদের অত্যাচার আর নির্যাতনের গল্প।
কিন্তু আজকাল বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে ও। একদম ঠান্ডা। কথা বলেনা। আজ তাই নিজেই ওকে গল্প শোনাতে গেলাম। ও আমায় জড়িয়ে ধরে। আমি জাপটে ধরে গল্প বলি। বাংলার দামাল ছেলেদের গল্প। মেয়েদের জেগে উঠার গল্প। মেয়েটা হঠাৎ গুমরে উঠে। আমি ওর দিকে তাকাই। কিছু হলো কি?
পরদিন আমি পুলিশে খবর দেই। পুলিশের লোকজন আমাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। ছোটখাটো ব্যাপার। এ বয়সে ছেলেরা একটু আধটু করেই। আমি শান্ত হইনা। আমার মেয়েটা আমার গা ঘেষে দাঁড়ায়। ছোট চাচাকে ফোন দেই। চাচা এসে চুপচাপ মতিকে নিয়ে যায়। আমি গেইটে এসে দাঁড়াই। চাচা আবারো বলে উঠে। চুপ থাকতে। না হলে পরিবারের অসম্মান। মেয়ের অসম্মান। মতিকে ওরা বুঝাবে। আমি হাসি।
“চাচা, আমি ওর মা হতে পারিনাই। আমি ওকে মানুষ বানাতে পারিনাই। ওর সাথে আমারো জেলে যাওয়া উচিত। “
চাচা আমার ঠান্ডা চোখের দিকে নির্বাক চেয়ে থাকে।