মা
ভদ্রমহিলা রোজ রোজ ফোন দিয়ে জ্বালান। আমি তার কথা শুনে শুনে অভ্যস্থ। আমি জানি উনি কখন কি বলবেন। আমি এটাও জানি উনি এখন আর ব্যস্ত নন। সন্ধ্যা হলে আমি উনাকে একটা কল দিয়ে তাই বিরক্ত করিনা।
মাঝে মাঝে খুব বেশি প্রয়োজন হলে আমি উনাকে জানাই। কিছু টাকা লাগবে। অথবা কিছু বই দরকার। নতুন গাছে কয়টা ফুল ফুটলো। খুব বেশি হলে বলে দেই ডায়াবেটিস টা মেপে নিয়ো। সেই এক ই উত্তর। যাওয়া হয়নাই। যাবো। আমি কিছু বলিনা। আমি জানি উনি কখন কি বলবেন। আমি এটাও জানি উনি এখন আর ব্যস্ত নন। যখন বেরোই কিংবা ঘুরতে যাই উনি তখন ও ফোন দিয়ে যান। আমি পাত্তা দেইনা।
আমার রাগ হয়। আমি খুব খুশি হলে কিংবা অসুস্থ হলে খুব জলদি তাকে মনে পড়ে। কেউ কেন আমার কথা শুনলোনা। কেউ কেন আমার ভালো চাইলোনা। বলে বলে তাকে অভিযোগ জানাই। তিনি তাতে বিরক্ত হোন না। খুব করে বুঝিয়ে দেন।
“কে কেমন ভেবোনা। তুমি শুধু ভালো করে যাও”
আমার রাগ হয়।তাকে দেখতে ইচ্ছে করে তখন। বন্ধুরা হাসাহাসি করে। তুই এখনো বাচ্চা আছিস। আমি রাগ করি। বেশি ক্ষোভ হয়। আমি আর কারো সাথে কিছু ভাগ করিনা। আমি আমার ত্রুটি গুলো একাই বয়ে নিয়ে যাই। আর মাঝেমাঝে ভদ্রমহিলা কে ফোন এ অভিযোগ জানাই।
যাদের আপন ভেবে সময় কাটাই তারা আমাকে ছাড়াই এখন দিব্যি থাকে। আমি তাদের জন্য মন খারাপ করি। খুব বেশি কঠোর হয়ে যাই। ভাবি আর ভাববো নাহ। পারিনা। ভদ্রমহিলা বুঝতে পারে। এসে যেচে কথা বলতে চায়। আমার তাকে অসহ্য লাগে। তার কাছে নিজেকে ছোট মনে হয়। বিশ্রী লাগে।
আমি আমার হতাশা গোপন করি। বুড়ো বয়সে তাকে ঝামেলায় ফেলতে চাইনা। উনি নিজেই এসে পড়েন। আমি বলি না কিছু। আমি জানি উনি কখন কি বলবেন। আমি জানি উনি এখন আর ব্যস্ত নন।
তারপর একদিন আমার মুক্তি হয়। ভদ্রমহিলা নিজেকে নিয়ে আর ভাবেন না। তার কিছু লাগেনা। তার কখনো মন খারাপ হয়না। তার কখনো ইচ্ছা করেনা আমার মতো সব ছেড়ে চলে যেতে। তিনি একাই টেনে নিয়ে যান সবাইকে। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর।
আমার অফুরন্ত আহ্লাদ, আমার আলসেমি, আমার রাগ, আমার অসুস্থতা,আমার ক্রমাগত হতাশ হতে থাকা। কিছুই তাকে বিচলিত করেনা। তিনি আগের মতোই বয়ে নিয়ে যান আমাকে। হোঁচট খেলে তুলে দেন আমাকে। আমি আবার চলি। আবার ভুল করি। আমার আবার অভিমান জাগে। জগতের সবাইকে অসহ্য লাগে। আমি অভিযোগ জানাই। বিরতিহীন। বিরামহীন। উনি কখনো ক্লান্ত হোন না শুনতে শুনতে।
আমি জানি উনি কখন কি বলবেন। আমি জানি উনি এখন আর ব্যস্ত নন।